আইনুদ সনি::
আমার বছর পাঁচবয়সী ছেলে জ্বর-সর্দি-কাশিতে ভুগছিলো কয়েকদিন ধরেই। ছেলেকে নিয়ে তার বাবার সাথে ঢাকাতেই একজন শিশু বিশেষজ্ঞের কাছে গিয়েছি। মাঝবয়সী সেই ডাক্তারের চেম্বারে রোগীর অভাব নেই, বেশ রাতের দিকে যাওয়ায় ততক্ষণে রোগীর সংখ্যা কমে গেছে। এক রোগী থাকতেই আরেক রোগীর ডাক পড়ছে … বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর ডাক পড়লো আমাদের।
সমস্যা শুনে আমার ছেলেকে খানিক দেখেই বললো নেবুলাইজ করাতে হবে। সেই রুমের ভেতরেই আরেক মা বসে তার ছোট বাচ্চাকে নেবুলাইজ করাচ্ছে। আমার ছেলের মুখে মাস্ক লাগিয়ে নেবুলাইজ শুরু করে আমাদেরকে বাইরে বসতে বলা হলো। এদিকে বাইরে আরও রোগী অপেক্ষা করছে।
বাচ্চাকে একা রেখে বাইরে যেতে মন না টানলেও মানতে হলো ডাক্তারের কথা। আমাদের পর আরও ৩ জন রোগী দেখলো। শেষের রোগী যখন বের হয়ে আসলো, তখন আমার ছেলে একা। এর মাঝে সেই মাও তার বাচ্চা নিয়ে বেরিয়ে এলো।
মনের মধ্যে আমার খুঁত খুঁত করা শুরু করলো। শুধু ডাক্তারের চেম্বারে পাঁচ বছরের একটা বাচ্চাকে একা বসিয়ে রাখতে মন সায় দিচ্ছিলো না। ছেলের বাবাকে অস্বস্তির বিষয়টা জানালে সে হেসেই উড়িয়ে দিলো, বললো আমি নাকি শুধু শুধু ভয় পাচ্ছি।
স্থির থাকার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলাম… রুমের দরজায় টোকা দিয়ে দরজাতেই দাঁড়িয়ে বললাম, ডাক্তার সাহেব, বাইরে কোন রোগী নেই, আমরা কি ভেতরে আসবো? ডাক্তার সাহেব চশমার উপর দিয়ে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে খুব কড়া করে বললেন, আপনাদের কি আমি ডেকেছি?
তারপরও বললাম, আমি ভেতরেই বসি, বাচ্চা আবার ভয় পেতে পারে। (এদিকে যে ভেতর ভেতর আমিই ভয় পাচ্ছি তা আর বুঝতে দিতে চাইলাম না।) তিনি হ্যাঁ বা না কিছুই বললেন না… কিন্তু মুখ দেখেই পরিষ্কার বুঝে ফেললাম যে তিনি বিরক্ত… তার চোখ রাঙানিকে উপেক্ষা করে আমি থ্যাংক ইউ বলে একটা চেয়ারে বসে পড়লাম।
ভীষণ খারাপও লাগছিলো, একজন মানুষ সম্পর্কে বাজে ধারণা করতে। কিন্তু আশেপাশে যা ঘটছে… গণমাধ্যমে প্রতিনিয়ত শিশু নির্যাতনের যে ঘটনাগুলো প্রকাশ পাচ্ছে… তাতে করে অপরিচিত কেন… পরিচিত মানুষকেও বিশ্বাস করা কঠিন হয়ে গেছে।
প্রায় প্রতিদিনই চোখে পড়ে দেশের কোথাও না কোথাও বিভিন্ন বয়সী শিশু নির্যাতনের ঘটনা। আর এই নির্যাতনের ভয়াবহতা উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে চলেছে। আর শিশু নির্যাতন বলতে এখন আর শুধু মেয়ে শিশুই নয়… ছেলে শিশুও নির্যাতনের ঘটনা বাড়ছে। বাসা, পথ-ঘাট, বাসস্ট্যান্ড এমনকি স্কুল-মাদ্রাসার মতো জায়গাতেও বিকৃতরুচির মানুষজন দ্বারা প্রতিনিয়ত যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে মেয়ে এবং ছেলে শিশু উভয়ই।
আমাদের সমাজে এখনও অনেকের ধারণা, মেয়ে শিশুরাই যৌন হয়রানির শিকার হয়। কিন্তু ছেলে শিশুরাও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়, যদিও বিষয়টি নিয়ে সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন হওয়ার আশংকায় কেউ মুখ খুলতে চান না সহজে।
অ্যাসোসিয়েশন ফর কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট পরিচালিত যৌনবৃত্তির ক্ষেত্রে ছেলে শিশুদের ঝুকিঁ নিরূপণ সম্পর্কিত সমীক্ষায় দেখিয়েছে যে শিশুরা সাধারণত নিকট আত্মীয় স্বজন কর্তৃক যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। আদরের ছলে বিভিন্ন ধরনের অশোভন আচরণ, যৌন ইঙ্গিত ও স্পর্শ থেকে আরম্ভ করে ধর্ষণসহ নানা ধরনের যৌন সহিংসতা এই খুব নিকট আত্মীয় স্বজন কর্তৃক ঘটে থাকে।
জাতীয় পর্যায়ে শিশুদের নিয়ে কাজ করে এমন ২৬৯টি বেসরকারি সংস্থার ফোরাম হলো বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম (বিএসএএফ)। সংগঠনটি এবছরের শুরুর দিকে শিশু অধিকার পরিস্থিতি নিয়ে বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ।
প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, ২০১৬ সালে ৩ হাজার ৫৮৯টি শিশু সহিংসতা ও নির্যাতনের শিকার হয়। এর মধ্যে ১ হাজার ৪৪১টি শিশুর অপমৃত্যু ঘটে। যৌন নির্যাতনের শিকার হয় ৬৮৬টি শিশু। তবে হত্যা, ধর্ষণ, অপহরণসহ সামগ্রিকভাবে শিশু নির্যাতনের সংখ্যা ২০১৫ সালের তুলনায় কিছুটা কমলেও বিএসএএফ মনে করে গত বছর গড়ে মাসে ২০টির অধিক শিশু হত্যা এবং ৩০টিরও বেশি শিশু ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে।
এ বিষয়ে সংগঠনটির চেয়ারপারসন মো. এমরানুল হক চৌধূরী বলেন, শিশু নির্যাতনের ভয়াবহতা বাড়ছে। বিচারহীনতা ও বিচারপ্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতার সংস্কৃতিই এর কারণ। প্রতিরোধে দরকার আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ ও সামাজিক সচেতনতা।
বিবিসি’র এক প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছিলো যে ‘ছেলে এবং মেয়ের আনুপাতিক হিসাবে ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের যৌন নির্যাতনের সংখ্যা বেশি। কিন্তু ছেলেদের ধর্ষণের ঘটনা আগে সীমিত ছিল। বোর্ডিং স্কুল বা মাদ্রাসায় হত। এখন সেই ক্ষেত্র সম্প্রসারিত হয়েছে।
লঞ্চ-ঘাটে, বাস টার্মিনালে কিংবা বিপণি বিতানে যেসব শ্রমজীবী শিশু থাকে কিংবা যারা পথশিুশ তারাও ধর্ষণের স্বীকার হচ্ছে। পরিবারের সদস্যদের দ্বারাও ধর্ষণের ঘটনা হচ্ছে। তবে সেগুলো চার দেয়ালের বাইরে আসে না।’
শিশুদের ওপর নির্যাতনের বিভিন্ন দিক নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং সমাজবিজ্ঞানী মাহবুবা নাসরীন। তিনি বলছেন, অনেকে অজ্ঞতার কারণে আর বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে অনেকেই আদালত বা পুলিশের দোরগোড়ায় পৌঁছাচ্ছেন না।
ফলে এসব অপরাধ ঘটছেই। অনেকে শিশু বা অভিভাবকই জানে না কোথায় অভিযোগ জানাতে হয়। যদিও নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে বলা আছে, ট্রাইবুনাল ১৮০ দিনের মধ্যে মামলা প্রক্রিয়া শেষ করবেন।
এক শ্রেণীর বিকৃত রুচির মানুষ শিশুদের টার্গেট করে, কারণ শিশুদেরকে একটা চকলেট দিয়েও প্রভাবিত করা যায়। ফলে সুযোগ সন্ধানী অপরাধীরা এভাবে শিশু নির্যাতনের সাথে জড়িত থাকে। এই নির্যাতিত শিশু ভবিষ্যত জীবনে নানারকম অপরাধকর্মের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকতে পারে।
কেননা তারা স্বাভাবিকভাবে গড়ে ওঠার সুযোগ পায় না। সেও অন্যের প্রতি এমন আচরণ করতে পারে। যৌন নির্যাতনের মতো অনাকাক্ষিত ঘটনায় কোমলমতি শিশুদের আবেগ ধ্বংস হয়ে যেতে পারে।
শিশু নির্যাতনমুক্ত সমাজ তখনই সম্ভব, যখন মানুষের মনোভাব, আচরণ ও রুচির পরিবর্তন হবে। সুতরাং আমাদের শিশুকে নিরাপদে রাখতে তাকে যৌন নির্যাতন সম্পর্কে সাবধান ও সচেতন করতে যে বিষয়গুলো খেয়াল রাখতে হবে, তা হলো :
১. শিশুর সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে যেন সে বিনা দ্বিধায় সবকিছু বাবা-মাকে খুলে বলতে পারে।
২. গল্পের ছলে তাকে যৌন শিক্ষা দেয়া যেতে পারে।
৩. শিশুদের ভয় না পেয়ে সবকিছু অবহিত করার বিষয়ে শিক্ষা দিতে হবে। তাদের বোঝাতে হবে যে এসব অনাকাঙ্ক্ষিত বিষয়ে তার কোনো দোষ ছিল না।
৪. তাদের শেখাতে হবে অপরিচিতদের থেকে কোনো কিছু গ্রহণ না করার ব্যাপারে। স্কুল থেকে বাবা-মা ছাড়া অন্যদের সঙ্গে কখনো যাবে না, এমন কি বাবা-মা যেতে বলেছে দাবি করলেও না।
৫. তাকে তার শরীরের সংবেদনশীল স্থানগুলো সম্পর্কে জ্ঞান দিতে হবে এবং এই স্থানগুলোতে যেন কেউ স্পর্শ করতে না পারে তা শেখাতে হবে।
৬. গুড টাচ ও ব্যাড ট্যাচ সম্পর্কে বোঝাতে হবে।
৭. নিকট আত্মীয়দের ব্যাপারেও অন্ধবিশ্বাস না করে সচেতন থাকতে হবে।
ডাক্তারের চেম্বারের দরজা ঠেলে ভেতরে যাবার ঘটনায় আমার ছেলের বাবা জিজ্ঞেস করছিলো, তুমি মেয়ে সন্তানের ক্ষেত্রে তাহলে কী করতে? উত্তর দিয়েছিলাম, আমি একই কাজ করতাম। শিশু নির্যাতনের ক্ষেত্রে ছেলে বা মেয়ে সমানভাবেই ঝুঁকিপূর্ণ। সুতরাং, শিশুর সুন্দর বর্তমান ও ভবিষ্যত নিশ্চিত করতে সকল শিশুর প্রতিই সমানভাবে সচেতন হতে হবে।
আইনুদ সনি : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক ও কলাম লেখক।
[email protected]
সুত্র: পরিবর্তন
পাঠকের মতামত